<article> <p style="text-align: justify;">প্রাচীন কাল থেকে পুকুরের শহর হিসেবে কুমিল্লার যথেষ্ট সুনাম ছিল। তবে গত দুই দশকের কিছু বেশি সময় ধরে শহরটির অসংখ্য পুকুর ভরাট করায় ওই সুনাম আর অক্ষুণ্ন থাকেনি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২৩ বছরে কুমিল্লা শহর এলাকায় শতাধিক পুকুর ও জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। প্রশাসনের সামনেই এসব পুকুর ও জলাশয় ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবনসহ অসংখ্য স্থাপনা।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">কেবল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তিগত উদ্যোগে নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেও কুমিল্লা শহরের বেশ কিছু পুকুর ও জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। কুমিল্লার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকজন এবং বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর কুমিল্লা শহরে আট শর বেশি পুকুর ছিল। বর্তমানে এই সংখ্যা ২০০ নিচে। এর মধ্যে গত ২৩ বছরে ভরাট করা হয়েছে শতাধিক পুকুর।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর শত বছরের পুরনো দুটি পুকুরের মধ্যে ১৩৫ শতকের পুকুরটি সম্পূর্ণ এবং ১২০ শতকের পুকুরটির ৪০ শতাংশ ভরাট করা হয়েছে। একইভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভরাট করা হয়েছে ২৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী শহরের দ্বিতীয় মুরাদপুর এলাকার  হাতিপুকুরের একাংশ। একই এলাকার শত বছরের পুরনো নারায়ণ পুকুরের উত্তর পাশের ৩৪ শতাংশ, শহরের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাজীপাড়া ঈদগাহ ও মসজিদসংলগ্ন বড়বাড়ির পুকুর, একই এলাকার কাজীপুকুর এবং ছোটরা জংলিবিবি পুকুরের বেশির ভাগ ভরাট করা হয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">গত ২৩ বছরে আরো যেসব পুকুর ভরাট করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ঝাউতলা খান সাহেবের পুকুর, লাকী হাউসের পুকুর, কাসেমুল উলুম মাদরাসার পাশের দুটি পুকুর, নাদিপা হাউজিং পুকুর, দক্ষিণ চর্থা থিরা পুকুর, শহরের উত্তর চর্থার তেলিয়া পুকুর, সংরাইশ এলাকার কালীমন্দির পুকুরসহ তিনটি পুকুর, কুমিল্লা অজিত গুহ মহাবিদ্যালয়ের সুপারিবাগানের দুটি পুকুর, দারোগাবাড়ির বড় অন্দরের পুকুর, কুমিল্লা শহরের ফরিদা বিদ্যায়তনের দক্ষিণ পাশের জনাদের পুকুর, ঝাউতলা খ্রিস্টানপাড়ার পুকুর, প্রফেসর পাড়ার চারটি পুকুর, কোতোয়ালি থানার পেছনের দুটি পুকুর, কুমিল্লা পুলিশ লাইনসের কয়েকটি পুকুর, ধর্মসাগর দিঘির পারে সড়ক ও জনপথ বিভাগের পুকুর।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">পুকুর ভরাটের প্রতিটি ঘটনায় দেখা গেছে, ভরাটের পর একটি পুকুরও আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারেনি প্রশাসন। লাগামহীন পুকুর ও জলাশয় ভরাটের কারণে কুমিল্লা শহরে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে জলাবদ্ধতা। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিবেশবিদরা বলেছেন, এখনো যে পুকুরগুলো অক্ষত আছে, সেগুলো রক্ষায় প্রশাসনকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। না হলে পুকুরের শহর কুমিল্লায় একসময় আর পুকুরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।</p> <p style="text-align: justify;">কুমিল্লা শহরের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের ঝাউতলা এলাকার খ্রিস্টানপাড়ায় ২০১৫ সালে ভরাট করা হয় বড় আকারের দুটি পুকুর। এর মধ্যে একটি পুকুর ভরাট করে বর্তমানে সেখানে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করছেন মোহাম্মদ ইউসুফ নামের এক ব্যক্তি। পুকুর ভরাট করে কিভাবে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে দেখতে ওই এলাকায় গেলে দেখা যায়, এরই মধ্যে ভবনটির তিন তলার কাজ শেষ হয়েছে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">তবে মোহাম্মদ ইউসুফকে পাওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউসুফের স্ত্রী রোকসানা আক্তার জানান, তাঁর স্বামী প্রবাসী। ২০১৮ সালে এখানকার জমি কিনে বর্তমানে বাড়ি নির্মাণকাজ শুরু করেছেন তিনি। রোকসানা জানান, সিটি করপোরেশনের অনুমোদন নিয়েই তাঁরা ভবনটি নির্মাণ করছেন। এই জমিতে আগে পুকুর থাকলেও তাঁরা ভরাট করেননি।</p> <p style="text-align: justify;">পাশেই আরেকটি বড় পুকুর ভরাট করেছেন খোরশেদ আলম নামের আরেক ব্যক্তির পরিবার। পুকুরটি ভরাট করে এক পাশে নির্মাণ করা হয়েছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। অন্য পাশে বহুতল ভবন নির্মাণের চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে। এসব বিষয়ে কথা বলতে ভরাটকারীদের কাউকে পাওয়া যায়নি।</p> <p style="text-align: justify;">তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ৭০ বছর বয়সী স্থানীয় এক বৃদ্ধ বলেন, দুটি পুকুরই শতবর্ষী। ভরাটের সময় স্থানীয়রা বাধা দিয়েছিল, কাজ হয়নি। বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, এলাকায় আগুন লাগলে নেভানোর জন্য একটু পানিও পাওয়া যাবে না।</p> <p style="text-align: justify;">এক দশক আগে কুমিল্লা শহরের শহীদ সামছুল হক সড়কের ওয়াপদা অফিস এলাকায় প্রয়াত হাফিজ উদ্দিনের পরিবারের সদস্য একটি পুকুর ভরাট করেন। ওই জায়গায় এরই মধ্যে দুটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে ১৩ তলা আরেকটি ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। ভবনটির অর্ধেক পড়েছে পুকুর ভরাট করা জায়গায়।</p> <p style="text-align: justify;">স্থানীয়রা জানায়, পুকুর ভরাটের পর প্রয়াত হাফিজ উদ্দিনের চার মেয়ের মধ্যে তিন মেয়ে তাঁদের অংশ বিক্রি করে দিয়েছেন। বড় মেয়ে তাঁর সম্পত্তি বিক্রি করেননি। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। পুকুর ভরাটের জায়গায় যাঁরা ভবন নির্মাণ করছেন এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তাঁরা। তাঁদের একটাই ভাষ্য, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন থেকে অনুমোদন নেওয়ার পর ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। </p> <p style="text-align: justify;">কুমিল্লার ইতিহাসবিদ ও গবেষক আহসানুল কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একসময় কুমিল্লা শহরে মানুষ যথেষ্ট কম ছিল। আর প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনে ছিল পুকুর। কোনো কোনো বাড়িতে দুটি পুকুরও ছিল। আমার জন্মের পর শহরের বজ্রপুর এলাকায় সাত থেকে আটটি পুকুর দেখেছি। বর্তমানে সেগুলোর অস্তিত্ব নেই। পুকুর ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে বহুতল ভবন। কুমিল্লায় আগে অনেক দিঘিও ছিল। সেগুলোও ভরাট হয়ে গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ১০০ বছর আগেও কুমিল্লা শহরে পুকুরের সংখ্যা ছিল হাজারের বেশি। এসব প্রাকৃতিক জলাধার ভরাটের ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই শহরে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।’  </p> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কুমিল্লার সভাপতি ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানও একের পর এক পুকুর ভরাট করেছে। সম্প্রতি জেলখানা কর্তৃপক্ষ দুটি পুকুর ভরাট ছাড়াও বিশাল একটি জলাশয় ভরাট করে ১৪ তলা ভবন নির্মাণ করেছে। এ ছাড়া পুলিশ, সড়ক ও জনপথ বিভাগও পুকুর ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করেছে। আমরা প্রতিবাদ করেও কিছু করতে পারিনি। পুকুরের শহর কুমিল্লা এখন পুকুরহীন হয়ে পড়ছে।’</p> <p style="text-align: justify;">শহরের মোগলটুলি এলাকার বাসিন্দা সফিকুল ইসলাম শিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পরও কুমিল্লা শহরে আট শতাধিক পুকুর ছিল। আশির দশকের আগে থেকে ব্যাপকহারে পুকুর ভরাট শুরু হয়। ভরাটের পর আজ পর্যন্ত একটি পুকুরও উদ্ধার করা যায়নি। প্রতিটি পুকুর ভরাট করে সেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন।’</p> <p style="text-align: justify;">নগরীর হাউজিং এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, ‘এসব পুকুর ও জলাশয় ভরাট করা হয় কৌশলে। দেখা যায়, ভরাটের সময় প্রশাসন বাধা দিলে ভরাটকারীরা কিছুদিন চুপ থাকে। এরপর কিছুদিন পার হলেই কখনো রাতে, আবার কখনো প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ভরাটের কাজ শুরু করা হয়। এ পর্যন্ত একটি পুকুরও ভরাট থেকে রক্ষা করতে পারেনি প্রশাসন।’</p> <p style="text-align: justify;">এদিকে কুমিল্লা শহরে পুকুর ভরাট করায় গত বছর চারটি মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর, কুমিল্লা কার্যালয়। এর আগেও একটি মামলা হয়েছিল। বেশ কয়েকজনকে নোটিশ দিয়ে ডেকে এনে পুকুর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার শর্তে জরিমানা আদায় এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানাও করা হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত একটি পুকুরও আগের অবস্থায় ফেরেনি।</p> <p style="text-align: justify;">পরিবেশ অধিদপ্তর, কুমিল্লার উপপরিচালক মোসাব্বের হোসেন মোহাম্মদ রাজীব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা কুমিল্লার ঐতিহ্য রক্ষায় কাজ করছি। কোথাও পুকুর, ডোবা ও জলাশয় ভরাটের তথ্য পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি। ২০২৩ সালে ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করা হয়েছে চারটি। আর সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান ভরাটের কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। জলাশয় ও পুকুর ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া অব্যাহত আছে।’</p> <p style="text-align: justify;">কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ছামছুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুকুর ভরাট বন্ধ করার দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। এসব বিষয়ে আমি আর কিছু বলতে পারব না।’</p> <p style="text-align: justify;">পুকুর ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি কিভাবে দিয়েছে সিটি করপোরেশন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি গত বছরের শেষ নাগাদ এখানে যোগদান করেছি। আমার যোগদানের পর এমন ঘটনা ঘটেনি। অতীতে হয়ে থাকলে সেটি অবশ্যই অন্যায়।’ </p> <p style="text-align: justify;">এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কাবিরুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দপ্তরে সরকারি পুকুরগুলোর তালিকা আছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুরের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। তবে আমরা এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছি। কোথাও অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কেউ পুকুর বা জলাশয় ভরাটের চেষ্টা করলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব।’</p> </article>