<p>সারা দেশে কোন ধরনের সড়কে কোন গাড়ি সর্বোচ্চ কত গতিতে চলতে পারবে, তা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু একই সড়কে বিভিন্ন ধরনের গাড়িকে ভিন্ন গতিতে চলতে বলা হয়েছে। লেনভিত্তিক গতি আলাদা করা হয়নি।</p> <p>সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এতে সড়কে শৃঙ্খলা না ফিরে বরং গতির ভিন্নতার কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। গতি নির্ধারণ করতে গিয়ে মান ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সড়কের প্রকারভেদ আলাদা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক সড়কের জন্য প্রতিটি গাড়ির ধরনে আলাদা গতি নির্ধারণ করা হয়েছে।</p> <p>যেমন সড়কে সবচেয়ে আলোচিত মোটরযান মোটরসাইকেল চালানোর গতি সড়কের মানভেদে ভিন্ন ভিন্ন নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল চালানো যাবে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার গতিতে, জাতীয় মহাসড়কে ৫০, আঞ্চলিক মহাসড়কে ৪০, ঢাকাসহ সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় ৩০ এবং শহরের সংকীর্ণ সড়কে সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে মোটরসাইকেল চালানো যাবে।</p> <p>একইভাবে যাত্রীবাহী গণপরিবহন, পণ্যবাহী যান, ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও অ্যাম্বুল্যান্স ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলোর মতো জরুরি সেবামূলক গাড়িগুলো এ আইনের আওতামুক্ত থাকবে। আবার জরুরি পরিস্থিতিতে সব গাড়ির ক্ষেত্রে আইন শিথিল থাকবে।</p> <p>মূলত গতিসীমা নির্ধারণ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সড়কে চলা গাড়ির বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে আনা। সড়কে গাড়ির গতি কমিয়ে দুর্ঘটনা কমাতে চায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সড়কে যানের গতি কমিয়ে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব হবে না। দুর্ঘটনা কমাতে সড়কে শৃঙ্খলা দরকার। শুধু যানের গতি কমলে শৃঙ্খলা কমে আসার কোনো সুযোগ নেই।</p> <p>বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিআরটিএর (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) উদ্দেশ্য সৎ।</p> <p>তারা দুর্ঘটনা কমাতে চায়। কিন্তু আফসোস, আমি এখানে বিজ্ঞানসম্মত উপায় খুঁজে পাচ্ছি না। বরং লেনভিত্তিক গতির বিষয়টি বাস্তবায়ন না করে একই সড়কে বিভিন্ন ধরনের গতির গাড়ি চালানোর অনুমোদনকে হাস্যকর মনে হচ্ছে।’</p> <p><strong>কোন সড়কে কত গতি</strong></p> <p>মোটরযান গতিসীমা নির্দেশিকা-২০২৪ অনুযায়ী গতকাল বুধবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বিআরটিএ। গতিসীমার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতি ৮০ কিলোমিটার এবং সর্বনিম্ন ৫০ কিলোমিটার। এ ক্যাটাগরির জাতীয় মহাসড়কে সর্বোচ্চ গতি ৮০ কিলোমিটার এবং সর্বনিম্ন গতি ৫০ কিলোমিটার। বি ক্যাটাগরির জাতীয় মহাসড়কে সর্বোচ্চ গতি ৭০ কিলোমিটার, সর্বনিম্ন ৪৫। জেলা সড়কে সর্বোচ্চ গতি ৬০ কিলোমিটার, সর্বনিম্ন ৪০।</p> <p>সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা সদরের মধ্য দিয়ে ব্যবহৃত জাতীয় মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতি ৪০ কিলোমিটার, সর্বনিম্ন ৩০। জাতীয় মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়ক ছাড়া সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও জেলা সদরের অভ্যন্তরীণ সড়কে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতি ৪০ কিলোমিটার এবং সর্বনিম্ন ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হয়েছে।</p> <p>উপজেলা মহাসড়কে সর্বোচ্চ গতি ৪০ কিলোমিটার, সর্বনিম্ন ৩০। শহর এলাকায় প্রাইমারি আরবান সড়কে সর্বোচ্চ গতি ৪০ কিলোমিটার, সর্বনিম্ন ৩০। শহর এলাকায় সংকীর্ণ/সংযোগ সড়ক ও অন্যান্য সড়কে সর্বোচ্চ গতি ৩০ কিলোমিটার, সর্বনিম্ন ২০ এবং গ্রামীণ সড়কে গতি গড়ে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হয়েছে।</p> <p>জানতে চাইলে বিআরটিএর সড়ক নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, ‘প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গতিসীমার বাস্তবায়ন নির্ধারণ করা হয়েছে। আমাদের সড়কের নকশা অনুযায়ী নির্ধারণ করা গতি ঠিক আছে।’</p> <p><strong>বড় বিনিয়োগের সুফল মিলবে না</strong></p> <p>দেশে এক্সপ্রেসওয়ের মতো মহাসড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ হচ্ছে শুধু চলার গতি বাড়ানোর জন্য। এমনকি গত বছরের সেপ্টেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেশে ৩৫০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। একদিকে উচ্চগতির বাহন আমদানির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে যানের গতি কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এই দুটি সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক কি না, এমন প্রশ্নও তৈরি হচ্ছে।</p> <p>পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গতি হতে হবে লেনভিত্তিক। প্রথম লেনে গতি বেশি থাকবে, দ্বিতীয় লেনে কম। তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা তৈরি হবে। পাশের দেশে এক্সপ্রেসওয়েতে ১৩০ কিলোমিটার গতিতেও গাড়ি চলে। আমরা শুধু মনে করি, গতি কমালে দুর্ঘটনা কমবে, কিন্তু এটা বিজ্ঞানসম্মত নয়। উল্টো লেনভিত্তিক গতি আলাদা না করলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়বে।’   </p> <p><strong>কোন পরিস্থিতিতে গতিসীমা শিথিল হবে</strong></p> <p>নির্ধারণ করা গতিসীমা আবশ্যিকভাবে মেনে সড়ক-মহাসড়কে মোটরযান চালাতে হবে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আবাসিক এলাকা এবং হাটবাজার ইত্যাদি সংলগ্ন সড়ক বা মহাসড়কে মোটরযানের সর্বোচ্চ গতিসীমা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান বা রাস্তা নির্মাণকারী বা উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্ধারিত হবে। তবে তা কোনোক্রমেই জাতীয় মহাসড়কের ক্ষেত্রে ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার এবং আঞ্চলিক মহাসড়কের ক্ষেত্রে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটারের বেশি হবে না।</p> <p>জরুরি পরিষেবায় নিয়োজিত মোটরযান, যেমন—অ্যাম্বুল্যান্স, ফায়ার সার্ভিস ইত্যাদির ক্ষেত্রে গতিসীমা শিথিলযোগ্য হবে। সর্বোচ্চ গতিসীমার এই বাধ্যবাধকতা শুধু স্বাভাবিক অবস্থায় প্রযোজ্য হবে, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, প্রখর রোদ, অতিরিক্ত বৃষ্টি, ঘন কুয়াশা ইত্যাদি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণযোগ্য নিরাপদ গতিসীমা প্রযোজ্য হবে; দৃষ্টিসীমা বেশি মাত্রায় কমে গেলে বা একেবারেই দেখা না গেলে মোটরযান চালানো বন্ধ রাখতে হবে।</p> <p>এক্সপ্রেসওয়ে, জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়কের উভয় দিকের প্রবেশমুখ ও নির্দিষ্ট দূরত্বে যানবাহনভিত্তিক নির্ধারিত গতিসীমাসংক্রান্ত চিহ্ন রাস্তা নির্মাণকারী বা উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রদর্শন করতে হবে।</p> <p>পাহাড়ি এলাকা, আঁকাবাঁকা সড়ক, বাঁক, সেতু, রেল বা লেভেলক্রসিং, সড়ক সংযোগস্থল, বাজার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের সামনে চিহ্ন প্রদর্শিত গতিসীমা প্রযোজ্য হবে।</p> <p>নির্দেশনায় বলা হয়েছে, মালবাহী মোটরযানসহ অন্যান্য স্বল্পগতির মোটরযান সর্বদা সড়কের বাঁ পাশের লেন দিয়ে চলাচল করবে। শুধু ওভারটেক (পাশ কাটিয়ে যাওয়া) করার সময় ডান লেন ব্যবহার করতে পারবে, কখনো বাঁ লেন দিয়ে ওভারটেক করা যাবে না।</p> <p>ওভারটেকিং নিষিদ্ধ না থাকলে রাস্তার ট্রাফিক সংকেত, সড়ক চিহ্ন দেখে এবং সামনে-পেছনে পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় জায়গা থাকলে নিরাপদ পরিস্থিতি বিবেচনায় ওভারটেক করা যাবে। এ সময় সামনে বিপরীত লেনে আগত গাড়ি এবং পেছনের গাড়ির অবস্থান ও দেখে ওভারটেকিংয়ের জন্য নিরাপদ দূরত্ব আছে কি না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে।</p>